বাংলাদেশে পোল্ট্রিশিল্প এখন তিন যুগে পদার্পণ করেছে। বাড়ীর ছাদ থেকে পোল্ট্রি এখন শিল্পে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পোল্ট্রি এখন বিশ্বের যে কোনো উন্নত দেশের শিল্পের সমান্তরাল। আধুনিকতা এবং টেকনোলজির ছোঁয়া লেগেছে দেশের প্রায় প্রতিটি ব্র্যান্ডেড কোম্পানিগুলোতে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অনেক মানদণ্ডে পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্পে উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে চলে গেছে। প্যারাগন, নারিশ, কাজী ফার্ম, নাহার, সিপি, নিউ হোপ, আর আর পি, আমান, এজি এগ্রো-সহ প্রায় সব ব্র্যান্ডেড কোম্পানিগুলোতে বায়ো-সিকিউরিটি বা পাখির আরাম-আয়েশ অথবা উৎপাদনশীলতা বা বিদ্যুৎসাশ্রয়ী, প্রতিটি বিষয়েই বিবেচনা করা হচ্ছে উন্নতবিশ্বের ফার্ম ব্যবস্থাপনা এবং টেকনোলজির উপর ভিত্তি করে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের পোল্ট্রিশিল্প উন্নত বিশ্বের মতোই সমৃদ্ধশালী।
সমৃদ্ধশালী এই শিল্প মাঝে মাঝেই চরম দুরাবস্থার মধ্যে পরে উদ্যোক্তাদের মানসিক এবং আর্থিক শক্তি হ্রাস করছে। গত দুই দশকে এই চড়াই-উতরাই এর দৃশ্য ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এই দৃশ্য অতীতে দেখেছি, বর্তমানেও দেখছি এবং ভবিষ্যতেও দেখব যদি না সঠিক একটি পলিসি তৈরী করা হয। মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদের সাথে যুক্ত সমস্ত অ্যাসোসিয়েশন এবং এই শিল্পের সাথে জড়িত পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে বাংলাদেশের পোল্ট্রিশিল্পের ভবিষৎ ম্যাপিং করা একান্ত প্রয়োজন।
পোল্ট্রিশিল্প একটি মৌলিক চাহিদার শিল্প। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা – এই পাঁচটি মানুষের মৌলিক চাহিদা। পোল্ট্রিশিল্পের অবস্থান সবার আগে কারণ, এটি খাদ্যশিল্পের অন্তর্গত। অথচ সবচেয়ে গুরুত্বের জায়গায় থেকেও বাংলাদেশের পোল্ট্রিশিল্প সরকারের সঠিক পরিকল্পনার আওতায় এখনও আসেনি। গত দুই দশকের পোল্ট্রিশিল্পের দিকে নজর দিলে এটাই পরিলক্ষিত হবে যে, আমাদের শিল্প ষড়ঋতুর মতোই এগিয়ে চলেছে। কখনও DOC- এর বাজার ভালো, আবার কখনও বা ধস ! কখনও ব্রয়লারের বাজার খামারিদের উৎসাহিত করে, আবার কখনও বা সেই খামারিরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। শত শত লেয়ার খামার বন্ধ হয়ে যায় অথবা খামারিরা রাস্তায় ডিম ভেঙে প্রতিবাদ করে আবার কখনও বা রমরমা ব্যবসা। এই অবস্থার মূল কারণ হলো সঠিক পরিকল্পনা এবং তথ্যের অভাব। নির্ভরযোগ্য একটি তথ্যভাণ্ডার এই মুহুর্তে পোল্ট্রিশিল্প রক্ষার জন্য ভীষণ প্রয়োজন। সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা উচিৎ ব্রিডারের সংখ্যা । GP এবং PS এর সংখ্যা পোল্ট্রিশিল্পের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টি সঠিকভাবে বিবেচনায় নেয়া হলে রমরমা ব্যবসা অথবা ধস নামার মত ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে।
ওয়েট মার্কেটে মুরগি এবং অনান্য মাছ-মাংস বিক্রি প্রতিনিয়তই জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করছে। এই ওয়েট মার্কেট বন্ধ করে প্রসেস মিট/ফিস মার্কেট জনস্বাস্থ্যের সাথে সাথে বর্তমান বাজারের এই অসামঞ্জস্যতা দূর করবে বলে এই শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ মনে করেন।
প্রচার ও প্রচারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে যেখানে সেখানে মুরগি জবাই বা কাটাকাটি করা যে নিরাপদ খাদ্যের মধ্যে পড়ে না, এই ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন। শুধু ঢাকা শহরের ৫ তারকা হোটেল বা কনভেনশন সেন্টারে নয়, বরং এই প্রচারণা প্রয়োজন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইমাম সাহেবদের এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিয়ে চোখের সামনে জবাই করা মাংসের তুলনায় ফ্রোজেন মাংস যে বেশি নিরাপদ সে ব্যাপারে বোঝানো। তিনি শুক্রবার মসজিদে নিরাপদ মাংস এবং ওয়েট মার্কেটের বিষয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এইসব কর্মকাণ্ড আমাদের সমাজে একটি পরিবর্তন আনতে সহায়তা করবে।
“ স্বপ্ন দেখার গুরুত্ব অনেক। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে আজ আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন না দেখলে হয়তো বাংলাদেশের জন্ম হতো না। আমরা কি স্বপ্ন দেখতে পারি না সবার জন্য নিরাপদ খাদ্যের? ”
স্বপ্ন দেখার গুরুত্ব অনেক। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে আজ আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন না দেখলে হয়তো বাংলাদেশের জন্ম হতো না। আমরা কি স্বপ্ন দেখতে পারি না সবার জন্য নিরাপদ খাদ্যের? নিরাপদ খাদ্য শব্দটি প্রতিদিনই উচ্চারিত হয় অনেকবার। সরকার নিরাপদ খাদ্যের উপর জোর দিয়ে অনেক কিছুই করছেন কিন্তু নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সেগুলোকে সেই গুরুত্ব দেন না। ফলে নিরাপদ খাদ্য কর্মসূচিসমূহ ৫ তারকা হোটেল বা কনভেনশন সেন্টার পর্যন্তই বক্তার মুখে মুখেই রয়ে যায়।
নিরাপদ খাদ্যের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে হাট-বাজারে বা খোলা জায়গায় হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগল জবাই বা মাংস কাটাকাটির কাজটি সবচেয়ে বড় অন্তরায় । পোল্ট্রিশিল্পের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা অ্যাসোসিয়েশনগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট বা মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে পারেন। এটা করলেই কাজ হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া আমাদের দেশে কোনোরকম পরিবর্তন আশা করা যায় না।
গাড়ির সিটবেল্ট বাঁধতে যেমন এখন আর কেউ বিরক্তবোধ করেন না, জাটকা ধরা যেমন অনেকাংশে কমে গেছে, তেমনি একদিন ওয়েট-মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে, যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা জনস্বার্থে এই কথাগুলো বলতে
পারি।
দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগোচ্ছে, এরপর এগোবে উচ্চ আয়ের দেশের দিকে । এই তো সময় স্বপ্ন দেখার। আসুন না সবাই মিলে স্বপ্ন দেখি, সারা দেশের পাড়ার মুদি দোকানগুলো হয়ে গেছে কনভেনিয়েন্ট শপ । বাজারের দোকানগুলো হয়ে গেছে সুপার শপ। গরু, খাসি, মুরগি-সহ সব রকমের মাংস সুন্দর সুন্দর প্যাকেটে সাজানো রয়েছে। ঘরমুখী মানুষ প্রয়োজনমতো কেনাকাটা করছে। চমৎকার রাস্তাঘাট, স্যুটে-বুটে বাঙালি আমজনতা (উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে লুঙ্গি-গামছার তথাকথিত বাঙালিয়ানা থেকে বের হয়ে আসতে হবে) লুঙ্গি বা গামছা আমাদের অপরিহার্য, যা ঘরের ভেতরে থাকবে – জনসম্মুখে নয়। উচ্চ আয়ের বাংলাদেশি মানুষজন একই মেট্রোরেলে চেপে যাতায়াত করবে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ আর চোখে পড়বেনা। কে কৃষক, কে বা শিল্পকারখানার কর্মী বা উচ্চপদস্থ কর্মচারী বা শিল্পপতি, সবাই সারি বেধে মেট্রোতে চলবে। সুপার মার্কেটে কে কী করেন বা কে কোথায় থাকেন, সেটা কোনো ব্যাপার নয়, বরং সবাই একই পণ্য কিনছেন এবং সবাই জীবনটাকে নিজের মতো করে উপভোগ করছেন।
আজ যদি আমরা এই স্বপ্ন দেখতে পারি। আশা করি এমন একটা দিন আমাদের জীবনে আসবে। আর এখনই আমরা নিশ্চিতভাবে নিরাপদ খাদ্যসহ অন্যান্য মাপকাঠিতে এগিয়ে যাব।
একটু একটু করে আমাদের সবাইকে পরিবর্তনের এই পথে হাঁটা শুরু করতে হবে। আমাদের এই পোল্ট্রিশিল্পের সবাই কি সচেতনভাবে কিছু প্রচার বা প্রমোশন করতে পারিনা, যা আমাদের শিল্পকে এগিয়ে নেবে, প্রভাবিত করবে পড়শিকে, এবং আরও অনেককে এবং একদিন সমগ্র দেশবাসীকে।
এই শিল্পের সাথে আমরা যারা জড়িত, আসুন না পরিবর্তনের জন্য কিছু অভ্যাস করি।
– চিল্ড মিট বা ফ্রোজেন মিট সপ্তাহে অন্তত একদিন খাবার টেবিলে রাখি।
– কাছের মানুষদের ওয়েট-মার্কেটের বিভৎসতা সম্পর্কে অবহিত করি।
– ওয়েট-মার্কেট কীভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ তা বর্ণনা করি।
– কোথাও বেড়াতে গেলে মিষ্টি বা ফল-মূলের বদলে নাগেট, সালামি বা এ জাতীয় চমৎকার মোড়কের রেডি টু ইট (Ready to eat) বা রেডি টু কুক (Ready to cook) খাদ্য বেছে নেই।
– সকালের নাস্তা বা বিকালের চায়ের সাথে কিছু চিকেনসমৃদ্ধ খাদ্যের রেসিপি তৈরি করা।
– স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামে চিকেনের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা
করা।
– পোল্ট্রি মিট সবচেয়ে নিরাপদ মাংস, এটা প্রতিটি অনুষ্ঠানে আপ্যায়ন করার জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী, এটা পরিচিত মানুষদের বোঝানো।
– বাজারে গেলে বড় বড় মুরগির খোঁজ করা।
আসুন স্বপ্ন দেখি, আপনার স্বপ্নই একদিন বয়ে নিয়ে আসবে পরিবর্তন। শিল্পের ঘটবে প্রসার এবং বাংলাদেশের মানুষ হবে পুষ্টিতে পরিপূর্ণ ।