আমাদের দেশে পোল্ট্রিই হচ্ছে সবচেয়ে সস্তার প্রাণিজ আমিষ। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এ শিল্প থেকে আসছে। বাংলাদেশের পোল্ট্রি হালাল মার্কেটে প্রবেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে এবং আশা করা যায় ২০২০ সাল নাগাদ পোল্ট্রি প্রসেসড পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করবে। এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হলে প্রাথমিক পর্যায়ে বছরে অন্তত ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৯৯ কোটি ৫২ লাখ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৮১ কোটি ডিম উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ডিমকেন্দ্রিক বাণিজ্য হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ নাগাদ প্রায় ১২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার ডিম বাণিজ্য হতে পারে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা জানায়, ২০২১ সাল নাগাদ দেশে প্রতিদিন ৫ কোটি ডিম ও প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টন মুরগির মাংসের প্রয়োজন হবে। এই চাহিদা পূরণ করতে এ খাতে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়বে। দেশের প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণ, এছাড়া বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি, সর্বোপরি দেশের দারিদ্র বিমোচনে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগি পালন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।
অত্যন্ত গর্বের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশে এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার (এজিপি) মুক্ত পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বিশ্বের সর্বাধিক পোল্ট্রি উৎপাদনকারি দেশ ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এজিপি’র ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলেও বাংলাদেশ সরকার তা পেরেছে। আমাদের দেশে পোল্ট্রিতে হেভি মেটাল সমস্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এন্টিবায়োটিকের যতগুলো বিকল্প আমাদের দেশে আছে অনেক দেশেই তা নেই।
এক যুগ আগেও সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ বছরে গড়ে ৪০টির বেশি ডিম খেতে পারত না। সেই দিন অবশ্য এখন বদলে গেছে। ধনী গরিব নির্বিশেষে যে খাবার সবার খাদ্য তালিকায় থাকে, সেটি হচ্ছে ডিম। এখন বছরে এখানকার মানুষ গড়ে ১০৩টি করে ডিম খাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যূনতম চাহিদার সমান।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, একজন মানুষের ন্যূনতম পুষ্টি চাহিদা পূরণে খাদ্যতালিকায় বছরে ১০৪টি ডিম থাকা দরকার।
গত জুনে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে,
“ বাংলাদেশে যেসব ডিম নকল হিসেবে
প্রচার করা হতো, তা আসলে
প্রাকৃতিক নিয়মে কিছু অস্বাভাবিক
আকৃতি ও রঙের ”
বাংলাদেশে যেসব ডিম নকল হিসেবে প্রচার করা হতো, তা আসলে প্রাকৃতিক নিয়মে কিছু অস্বাভাবিক আকৃতি ও রঙের।
গবেষণাটি করেছেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের তিনজন গবেষক। তাঁদের গবেষণায় বলা হয়, দেশে উৎপাদিত ডিমের ২-৪ শতাংশ কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে থাকে। এসব অস্বাভাবিক ডিম বাজারে এলে সেগুলোকে চীনের তৈরি কৃত্রিম বা নকল ডিম হিসেবে এত দিন প্রচার করা হয়েছে। আদতে এসব ডিম আর দশটা ডিমের মতোই পুষ্টিমানসমৃদ্ধ।
আকৃতি ও রঙের ক্ষেত্রে অন্য ডিমের চেয়ে দেখতে আলাদা হওয়ার কারণে এসব ডিম নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোথাও নকল ডিম পাওয়া গেছে এমন সংবাদ প্রকাশের পর গবেষকরা সেখানে গিয়ে ডিমগুলো সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা দেশের ২৫টি জেলা থেকে এমন ৩ হাজার ৬৬০টি ডিমের নমুনা সংগ্রহ করে তা গবেষণাগারে পরীক্ষা করেন। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নথুরাম সরকার, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাকিলা ফারুক ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আতাউল গণি রব্বানী।
২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত তাঁরা গবেষণাটি করেন। সীমান্ত স্থলবন্দর, বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলার বিভিন্ন ছোট-বড় বাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন পোল্ট্রি মার্কেট থেকে তাঁরা ডিমের নমুনাগুলো সংগ্রহ করেন। নমুনাগুলোর সঙ্গে ইনস্টিটিউটের পোলট্রি গবেষণা খামারের ডিমেরও তুলনা করা হয়। তাতে কোনো ধরনের অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে নথুরাম সরকার বলেন, ‘যেসব ডিমকে নকল হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, সেগুলো পরীক্ষা করে আমরা অন্য স্বাভাবিক ডিমের মতো একই পুষ্টিমান পেয়েছি। শুধু দেখতে ভিন্ন হওয়ার কারণে এগুলোর বিষয়ে একদল মানুষ অপপ্রচার চালিয়েছে।
পোল্ট্রি ও গবাদিপশু পালন বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এবং গ্রামীন জীবিকার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবে বাণিজ্যিক ভাবে পোল্ট্রি, গবাদি পশু এবং মাছের খামারগুলি গত দুই দশক ধরে খ্যাতি অর্জন করেছে। এই বিশাল চাহিদার কারনে, বাণিজ্যিক ফিড উৎপাদন গত এক দশকে প্রায় ২৫% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ফিডের মান এবং ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার জন্য নিম্নমানের ফিড উৎপাদনকারীরা বাজার থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে।
পোল্ট্রি, গবাদি পশু এবং মাছের খামারগুলির মধ্যে, বর্তমান বাণিজ্যিক ফিড বাজারে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পোল্ট্রি ফিড রয়েছে। পোল্ট্রি ফিডের মধ্যে প্রায় ১০-১৫% ফিড লাগে ব্রিডার ফার্মের জন্য আর বাকি ৮৫-৯০% ফিড লাগে একদিনের বাচ্চা থেকে শুরু করে ব্রয়লার এবং লেয়ার ফার্ম এর জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে সোনালী মুরগীর জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে দেশে আনুমানিক প্রতি মাসে ১ কোটির বেশী – সোনালী মুরগী উৎপাদন হচ্ছে। ব্রয়লার লেয়ার এবং সোনালী ফিডের আনুমানিক সম্মিলিত বৃদ্ধি পরবর্তী ৫ বছরের জন্য ৯% বলে মনে করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি ফিডের মধ্যে গবাদি পশু ক্যাটেল ফিডের বাজার বেশী উন্নত হয়েছে। গরু মোটাতাজাকরণ এবং দুগ্ধজাত গবাদি পশুর জন্য বাণ্যিজিক ফিডের পাশাপাশি ঘরে তৈরী ফিডেরও উৎপাদন বেড়েছে।
দুধের চাহিদার বৃদ্ধির পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ৯-১০% অনুমান করা যায়। বর্তমানে মাথাপিছু মাংস এবং দুধের ব্যবহার প্রায় ৫০% রয়েছে। WHO এর মান অনুসারে প্রতিবছর মাথাপিছু মাংসের বার্ষিক ব্যবহার ১০ কেজি হওয়া উচিত কিন্তু বর্তমানে মাথাপিছু এর ব্যবহার বার্ষিক ৪ কেজি এর মত। দুধের ব্যবহার প্রতি মাথাপিছু ২৫০ মিলিলিটার হওয়া উচিত কিন্তু এর ব্যবহার হচ্ছে ১৫৮ মি.লি. । তাই এই দুটি বিভাগের জন্য প্রচুর বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
সারাদেশে কম বেশী মাছ উৎপাদন হলেও মূলত দেশের সর্বাধিক মাছ উৎপাদিত হয় ময়মনসিংহ এবং খুলনা জেলাতে। যা ৭০-৮০% অনুমান করা হয় দেশের মোট উৎপাদনের।
এইসব অঞ্চলের খামার গুলিতে দেরীতে হলেও ভাসমান ফিডের চাহিদা বেড়েছে। যেটি বাংলাদেশের ফিস ফিড ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভাল খবর।
বাংলাদেশের বাণ্যিজিক ফিড শিল্পকে তিনটি বিভাগে ভাগ করা যায়। প্রতিটি বিভাগে আবার দুটি উপ বিভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
• পোল্ট্রি ফিড : মোট উৎপাদন প্রতিমাসে :
৩৪২৮৭৯ মেট্রিক টন
• ব্রয়লার : ১৭০৬৪০ মেট্রিক টন
• লেয়ার : ১৭২৭৩৯ মেট্রিক টন• ফিশ ফিড : মোট উৎপাদন প্রতি মাসে :
৯৯৪১৯ মেট্রিক টন
• ডুবন্ত : ৬৩৩১৯ মেট্রিক টন
• ভাসমান : ৩৬৫০০ মেট্রিক টন
• ক্যাটেল ফিড : মোট উৎপাদন প্রতি মাসে :
৬৬৮২১ মেট্রিক টন
• মোটা তাজাকরন : ২০ ০৪৬ মেট্রিক টন
• দুধ উৎপাদন : ৪৬৭৭৫ মেট্রিক টন
(সূত্র : পোল্ট্রি খামার বিচিত্রা)
আপনি পোল্ট্রি শিল্পের যে কোন একটি দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন তবে ভবিষ্যতে আপনাকে এর সাথে লিংকেজ যুক্ত বিভাগ গুলিও আপনার ব্যবসায় যুক্ত করতে হবে। অন্যথায় আপনার ব্যবসা টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে ৬০% বাজার দখল করে আছে ১০ টির মত কোম্পানি যারা পোল্ট্রি ব্যবসার সাথে যুক্ত সকল বিভাগ দিয়ে শুরু করেছে এবং আরো কিছু কোম্পানি এর সাথে যুক্ত
হচ্ছে।
শীর্ষ বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ :
ব্রিডার ফার্ম:
- কাজী ফার্মস গ্রুপ
- নাহার এগ্রো
- নারিশ
- প্যারাগন
- প্রোভিটা
- সিপি বাংলাদেশ
বাণিজ্যিকভাবে ব্রয়লার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান:
- সিপি বাংলাদেশ
- কাজী ফার্মস
- প্যারাগন গ্রুপ
- আফতাব
- আফিল এগ্রো
- মৌলভীবাজার পোল্ট্রি
বান্যিজিকভাবে লেয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান:
- প্রোটিন হাউজ
- কাজী ফার্মস
- প্যারাগন গ্রুপ
- সিপি বাংলাদেশ
- নর্থ এগস
- আফিল এগ্রো
(সূত্র: পোল্ট্রি খামার বিচিত্রা)
বাংলাদেশে পোল্ট্রির উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে কিছু ঝুকিও তৈরি হয়েছে। এই ঝুকি নিরসনের জন্য একটি ন্যাশনাল প্লান দরকার। পর্যাপ্ত পরিমানে সরকারী সহযোগীতা না থাকায় একটি সম্ভামনাময় শিল্প হওয়া সত্ত্বেও অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে দেশের এই শিল্পটি। টেকসই উন্নয়ন ও সবার জন্য পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে পোল্ট্রি খামারগুলোকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশ করতে হলে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে, তাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান সংকট নিরসন করা সম্ভব না হলে এই বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না। বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যাংক ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে হবে এবং পোলট্রি খাতকে বীমার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের জন্য অনেক উপাদান বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। এই উপাদানগুলো আমদানিতে ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। বিদেশী কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে কি পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে কিংবা কি পরিমাণ লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরী করতে হবে। দেশে অনুন্নত ফিড মিলগুলোকে উন্নত করার পাশাপাশি আধুনিক ফিড মিল স্থাপন করতে হবে। এবং অবৈধ ফিডমিলগুলোকে পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে।